আ’লীগের কমিটিতে এমপি ফিরোজ সভাপতি, ছেলে সিনিয়র সহ-সভাপতি!

প্রকাশিত: ৩:৫৭ পিএম, নভেম্বর ৩০, ২০১৯
  • শেয়ার করুন

পটুয়াখালী-২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) সাবেক চিফ হুইপ সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজ ৪০ বছর ধরে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সদ্য অনুষ্ঠিত সম্মেলনেও পুনরায় তিনি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে খুব একটা বিতর্ক হতো না যদি সভাপতির পরের পদ অর্থাৎ সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে না আসত তারই ছেলে রায়হান সাকিব। এ নিয়ে বাউফলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

জানা যায়, বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) বাউফল উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নিজের অবর্তমানে যাতে পরিবারের হাতে দলের নিয়ন্ত্রণ থাকে সেজন্যেই ছেলেকে সহ-সভাপতি করা হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ।

তবে এমপি ফিরোজ দাবি করেছেন, এক্ষেত্রে তার কোনো হাত ছিল না। জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রস্তাব এবং সম্মেলনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের সমর্থনে কমিটি ঘোষণা হয়েছে।

এদিকে উপজেলা সম্মেলন নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। দলের একটা অংশকে বাদ দেয়ায় সম্মেলন করায় পাল্টা হিসেবে একই দিন এবং সময়ে সম্মেলন করে ফিরোজ বিরোধীরা। সেই সম্মেলন থেকে পাল্টা কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

বাউফলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নতুন নয়। প্রায় ৪০ বছর ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজের বিরুদ্ধে দলের একটি বিশাল অংশ একাট্টা।

কমিটি গঠন নিয়ে আদালতে মামলা থেকে শুরু করে ফিরোজের সংসদ সদস্য পদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট পর্যন্ত করেন বিরোধীরা।

স্থানীয় রাজনীতির এমন সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে বাউফলজুড়ে একটিই আলোচনা যে, যারাই ফিরোজের বিরোধিতা করেন তাদেরই পদ-পদবি থেকে সরিয়ে ছিটকে ফেলা হয়। আর এ কারণেই বাউফলে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এমপি ফিরোজ বিরোধী অংশ। এর প্রমাণ পৌর নির্বাচনে এমপি ফিরোজ মনোনীত প্রার্থীকে হারিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিয়াউল হক জুয়েলের মেয়ার নির্বাচিত হওয়া।

এমপি ফিরোজের সমর্থকরা অবশ্য এসব অভিযোগ মানতে নারাজ। উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব হাওলাদার বলেন, ‘বাউফলে আওয়ামী লীগ মানেই এমপি ফিরোজ। এখানে যুগের পর যুগ দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন তিনি। তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে কিছু লোক বিএনপি-জামায়াতের নেপথ্য মদদে দলের ভেতরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তবে তারা যে ব্যর্থ সেটা এরই মধ্যে প্রমাণ হয়েছে। বাউফলে আওয়ামী লীগ এমপি ফিরোজের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।’

একটিমাত্র উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন বাউফলে যখন আওয়ামী লীগে এমন পরিস্থিতি ঠিক সেই মুহূর্তে বৃহস্পতিবারের সম্মেলন হয়। এ আয়োজন নিয়ে সৃষ্টি হয় জটিলতা। এমপি ফিরোজের নেতৃত্বাধীন কমিটি আয়োজিত সম্মেলনে দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদকসহ সাবেক কমিটির বহু নেতা ও ত্যাগী পরীক্ষিতদের আমন্ত্রণ না জানানোর অভিযোগ ওঠে।

এমনকি পৌর মেয়র জেলা আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক জিয়াউল হক জুয়েল এবং সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মজিবর রহমানও অভিযোগ করেছেন সম্মেলনে আমন্ত্রণ না পাওয়ার।

এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা শহরের আদালত চত্বরে এমপি ফিরোজ সমর্থিত এবং পৌর এলাকার ৩নং ওয়ার্ডের লিচুতলা এলাকায় ফিরোজ বিরোধীরা আয়োজন করে পাল্টাপাল্টি সম্মেলনের। দুই আয়োজনেই যোগ দেন বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী।

জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাড. শাহজাহান মিঞা এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কাজী আলমগীর এমপি ফিরোজের আয়োজনে যোগ দেন। আর অপর সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মজিবর রহমান।

দুই সম্মেলন থেকে দুটি কমিটি ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এমপি আ স ম ফিরোজকে সভাপতি, তার ছেলে রায়হান শাকিবকে ১নং সহ-সভাপতি এবং আ. মোতালেব হাওলাদারকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি কমিটি হয়েছে।

বিপরীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা জসিম ফরাজীকে সভাপতি এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর উল্লাহকে সাধারণ সম্পাদক করে আরেকটি কমিটি হয়েছে।

পাল্টাপাল্টি সম্মেলন নিয়ে তীব্র উত্তাপ থাকলেও শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সবকিছু শেষ হলেও বর্তমানে বাউফলজুড়ে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হল ৪০ বছরের ধারাবাহিকতায় আবারও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি হওয়া এমপি ফিরোজের পুত্র রায়হান সাকিবকে উপজেলা আওয়ামী লীগের ১নং সহ-সভাপতি করা। সামনা-সামনি কেউ কিছু বলার সাহস না পেলেও বিষয়টি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে।

অনেকেই বলছেন যে, পারিবারিক রাজনীতির বলয়ে দলকে রাখতেই এমন কাজ করেছেন আ স ম ফিরোজ। এখানে অনেক জ্যেষ্ঠ এবং ত্যাগী নেতা রয়েছেন যারা সহ-সভাপতি এমনকি সভাপতি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তাদের আনা যেত এ পদে। তাছাড়া বাউফল আওয়ামী লীগের কার্যক্রমেও কখন দেখা যায়নি সাকিবকে।’

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘এর আগে সংসদ নির্বাচনে ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে যখন আ স ম ফিরোজের মনোনয়নপত্রের বৈধতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয় তখনও ছেলে রায়হান সাকিবের নামে মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন ফিরোজ। অথচ দলে এমপি পদে নির্বাচন করার মতো যোগ্য অনেক নেতা রয়েছেন। এ ঘটনাই প্রমাণ করে যে তিনি চান না তার পরিবারের বাইরে কেউ দলের নেতা হোক।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আ স ম ফিরোজ বলেন, ‘জেলার নেতারা উপস্থিত থেকে আমার ছেলের নাম প্রস্তাব করেছেন। সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এখানে কোনো শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়নি। যারা আমাকে পছন্দ করে না তারা দলের মধ্য দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে। যারা দলকে ভালোবাসেন তারা এ কমিটিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। একটি মহল সম্মেলন পণ্ড করার পাঁয়তারায় লিপ্ত ছিল। সফল না হয়ে তারা নেতাকর্মীদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।’